বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০৮ অপরাহ্ন

বাংলাদেশ রেলওয়ে সকল নিয়োগ-টেন্ডার-লিজ নিয়ন্ত্রণে সাবেক রেলমন্ত্রীর আত্মীয় শাহ আলম

বাংলাদেশ রেলওয়ে সকল নিয়োগ-টেন্ডার-লিজ নিয়ন্ত্রণে সাবেক রেলমন্ত্রীর আত্মীয় শাহ আলম

বিশেষ প্রতিবেদক:  রেলের রাজা হিসেবে পরিচিত শাহ আলম বিগত আওয়ামী ফ্যাসিবাদ সরকারের রেলমন্ত্রীর আত্মীয় হাওয়ার সুবাদে পূর্বাঞ্চল রেলের নিয়োগ-লিজ-টেন্ডার শাহ আলম সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন।
চট্টগ্রাম পূর্বাঞ্চল রেলের অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মচারীর অভিযোগের ভিত্তিতে রেল মন্ত্রণালয় তদন্তে নেমেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীর আত্মীয় ঠিকাদার শাহ আলমের বিরুদ্ধে।
রেল সূত্রে জানা যায় রেলওয়ে উপদেষ্টা বরাবরে পূর্বাঞ্চল রেলের অবসরপ্রাপ্ত নিম্নমান সহকারী আবদুল হাই সরকারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটির নিকট আগামী ১৪ নভেম্বর, ২০২৪ বৃহস্পতিবার সকাল ১০.০০ টায় প্রয়োজনীয় নথিপত্র সহ পূর্বাঞ্চল রেলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা (পূর্ব) চট্টগ্রাম বিভাগ, চট্টগ্রাম, বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ রেলওয়ে, কমলাপুর, ঢাকা, বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা চট্টগ্রাম বিভাগ, চট্টগ্রাম‌, স্টেশন ম্যানেজার, বাংলাদেশ রেলওয়ে, চট্টগ্রামকে উপস্থিত নির্দেশ দিয়েছেন রেল মন্ত্রণালয় ।

পূর্বাঞ্চল রেলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিতে শাহ আলম ব্যবসায়িক পাটনা হিসেবে দলে টানেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর কে। এই প্রভাবশালী নেতার মাধ্যমে রেলওয়ে কর্মকর্তাদের ভয় ভীতি দেখিয়ে শাহ আলম সিন্ডিকেটের কথামতো কাজ করতে বাধ্য করানো হয়। যখন যে সরকার আসুক ওই সরকারের প্রভাবশালীদের মন্ত্রী-সচিব ও মহাপরিচালকে ম্যানেজ করেই পূর্বাসঞ্চল রেলের সকল নিয়োগ-টেন্ডার-লিজ নিয়ন্ত্রণে নেন শাহ আলম সিন্ডিকেট।

শাহ আলমের ব্যবসায়িক পার্টনার মহানগর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী একাধিক মামলার আসামি হয়ে আত্মগোপনে গেলেও শাহ আলম রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।জানা যায় ৫ আগস্টের ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর  পূর্বাঞ্চল রেলের টেন্ডার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য বিএনপি-জামাত এর কেন্দ্রীয় নেতাদের শাহ আলম সিন্ডিকেটের সদস্য করে রেল মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সচিব ও রেল সদর দপ্তরের মহাপরিচালকসহ কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ঢাকায় অবস্থান করতেছেন শাহ আলম।

রেলওয়ে উপদেষ্টা বরাবরে পূর্বাঞ্চল রেলের অবসরপ্রাপ্ত নিম্নমান সহকারী আবদুল হাই সরকারের অভিযোগের ভিত্তিতেই বেরিয়ে আসেন চাঞ্চল্যকরসকল তথ্য।
জানা যায় শাহ আলম সিন্ডিকেট চট্টগ্রাম নগরীর আইসফ্যক্টরি রোডে রেলের কাছ থেকে এক বছরের জন্য দুই দশমিক তিন একর জমি লিজ নেন তিনি। আইস ফ্যাক্টরি রোড ব্যবসায়ী সমিতি লি. ও চুনারগুদাম ট্রাক মালিক সমবায় সমিতি লি. এর নামে মূল্যবান জমি এক বছরের জন্য লিজের লাইসেন্স নেন। দুটি সমিতির সভাপতি জহির আহমদ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম।

রেলের ভূসম্পদ বিভাগের সাবেক একজন কর্মকর্তা বলেন, আইসফ্যাক্টরি রোডের জমিটি খুবই মূল্যবান। ষাটের দশকে জমিটি চুনারগুদাম ট্রাক মালিক সমিতির কাছে একবার লিজ দেয়া হয়েছিলো। ওই সূত্রধরে শাহ আলম যখন এ জমি লিজের জন্য আবেদন করেন তখন ভূসম্পদ বিভাগ দ্বিমত করেছিলো। কারণ দোহাজারী-ঘুনধুম রেললাইনের চট্টগ্রাম অংশের কাজ শুরু হলে সেই জমি প্রয়োজন হবে রেলের। ঘুনধুম লাইনের ট্রেনের প্লাটফরম করতে সেই জমি প্রয়োজন হবে। ভবিষ্যতে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে করিডোরের সাথে যুক্ত হবে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন। ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্কের আওতায় এ রেলপথ সিঙ্গাপুর, চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যন্ড ও কোরিয়া হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত করার পরিকল্পনা রয়েছে। ভূসম্পদ বিভাগ বিরোধিতা করলেও পূর্বাঞ্চল রেলের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক জমিটি লিজ দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন।

২০১৮ সালের শেষের দিকে আইসফ্যাক্টরি রোডে শাহ আলম রেলের জমি লিজ নিয়েছেন ২ দশমিক ০৩ একর। তারপরও তার নজর সরেনি রেলের জমি থেকে। আশেপাশে আরো এক দশমিক ৬৮ একর জমি দখলে নিয়ে শক্ত স্থাপনায় গড়ে তুলেছেন মার্কেট। প্রতিটি দোকান দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি করে বিক্রি করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, কোনটি ১৫ লাখ কোনটি ২০ লাখ আবার কোনটি ২৫ লাখ টাকায় দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তিতে দোকান কিনেছেন ব্যবসায়ীরা।

শাহ আলম একাধিক গণমাধ্যমকে জানান আইসফ্যাক্টরি রোডের জমিটি এক বছরের জন্য লিজ নিয়ে লিজের শর্ত মেনেই শাহ আমানত মার্কেট তৈরি করা হয়েছে। এতবড় মার্কেট আমার একার পক্ষে করা সম্ভব নয় বিধায় একটি ডেভলপার প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে মার্কেটটি নির্মাণ করা করিয়েছি। এক বছরের লিজ নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদী দোকান বিক্রি করা প্রসঙ্গে শাহ আলম গণমাধ্যমকে আরো জানান, দোকান বিক্রয়ের সময় ক্রেতাদের বলে দেয়া হয়েছে জমিটি এক বছরের জন্য লিজ নেয়া হয়েছে। তারা সবকিছু জেনেশুনেই নিয়েছেন। তবে রেল সন্তুুষ্ট থাকলে মেয়াদ শেষে লিজের লাইসেন্স নবায়ন করতে পারবে।পুর্বাঞ্চল রেলের ভূ-সম্পদ বিভাগসূত্রে জানা যায়, শাহ আলমের নামে আইসফ্যাক্টরি রোডে ২ দশমিক তিন একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তিনি সেখানে অস্থায়ী সেমিপাকা দোকান করার কথা বলে এক বছরের জন্য লিজের লাইসেন্স নিয়েছেন। উক্ত লাইসেন্স সম্পূর্ণ অস্থায়ী। লাইসেন্সকৃত স্থানে কোনরকম পাকা স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবে না। ভবিষ্যতে রেলওয়ে বা সরকারিকারের নিজস্ব কাজে প্রয়োজন হলে উক্ত ভূমির লাইসেন্স বাতিল করা হলে এক মাসের নোটিশে রেলভূমি খালি করে নিষ্কন্টক দখল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য থাকবে। এক্ষেত্রে লিজগ্রহীতা কোন ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবে না। এমনকি রেলের বিরুদ্ধে আদালতে কোন মামলাও করতে পারবে না। নিজ খরচে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের ব্যবস্থাও লিজ গ্রহীতা করবেন। সর্বদা এ ভূমি অবৈধ দখলমুক্ত রাখতে হবে। কোনমতেই উক্ত জমি কারো কাছে হস্তান্তর করতে পারবে না এবং নির্মিত দোকান বিক্রি করতে পারবে না।

আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে আইস ফ্যাক্টরি রোডের ওই মার্কেট সরেজমিনে পরিদর্শন করছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তিন সদস্যের একটি টিম।দুদক সূত্রে জানা যায়, জায়গাটি খুবই কম মূল্যে ইজারা দেয়া হয়েছে। নিয়ম না মেনে ইজারা নিয়ে সেখানে মার্কেট গড়ে তোলা হয়েছে, কিভাবে কোন শর্তে মূল্যবান জমিটি ইজারা দেয়া হয়েছে তার তথ্য চেয়ে রেলের ভূসম্পদ কর্মকর্তার কাছে চিঠি দেয়াও হয়েছে। কিছু কাগজপত্র দিয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় মূল কাগজপত্র দেয়নি।দুদক সূত্রে আরো জানা যায়, কাগজপত্রের তাগাদা দিয়ে রেলকে ফের চিঠি পাঠানো হলেও পূর্বাঞ্চল রেলের কর্মকর্তাদের গড়ি মসির কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।উক্ত জমি ইজারা নেওয়ার সময় রেলওয়ের তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজারের সই জাল করেন শাহ আলম।

পূর্বাঞ্চল রেলের জমি লিজ নেয়াই তাঁর প্রধান পেশা। ‘রেলে যা চান তাই পান শাহ আলম। কখনো নিজেরর নামে কখনো স্ত্রী ইয়াসমিন আলমের নামে রেলের জায়গা ও দোকানপাট কৌশলে ভাড়া ও টেন্ডারের নামে হাতিয়ে নেন। এরপর রেলের জায়গায় স্থায়ীভাবে গেঁড়ে বসেন। রেলের জমি দখলে রাখতে প্রয়োজনে আদালতে মামলা টুকে দেন। সিআরবি সাত রাস্তার মোড়ে স্ত্রীর নামে জমি লিজ নিয়ে গড়ে তুলেছেন তাসফিয়া গার্ডেন নামের একটি রেস্টুরেন্ট। ওই রেস্টুরেন্ট তৃতীয় আরেকজনকে ভাড়া দিয়েছেন। আইস ফ্যাক্টরি রোড এলাকায় রেলের জমিতে গড়ে তুলেছেন স্বপ্নীল গ্রামার স্কুল। তিনি উক্ত স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। তাছাড়া পাহাড়িকা, উদয়ন ট্রেনের খাবার সরবরাহের ঠিকাদারও তিনি। চট্টগ্রাম পুরাতন রেলেস্টেশনের হোটেল হেরিটেজও লিজ নিয়েছেন তিনি। তাছাড়া চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত রেলের প্রতিটি স্টেশনেই রয়েছে দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।পূর্বাঞ্চল রেলের প্রভাবশালী শাহ আলম সিন্ডিকেটের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-শাহ আলমের মালিকানাধীন এসএ করপোরেশন ও ইউনিক ট্রেডার্স, নওফেল আহমেদের মেসার্স হাইটেক কনস্ট্রাকশন লিমিটেড এবং মো. বিল্লাল হোসেনের (বেলাল হুজুর নামে পরিচিত) মোহাম্মদী ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইউনিকন লিমিটেড।২০১৯ সালের আগে এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কনস্ট্রাকশন কাজের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও ২০২০-২০২১ , ২০২১-২০২২, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে অভিজ্ঞতার ভুয়া সনদ দিয়ে কোটি কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়েছে শাহ আলম সিন্ডিকেট। অভিযোগ আছে, নিজেদের মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে কাজ বাগিয়ে দিতেও তারা সহযোগিতা করে। এক্ষেত্রে কাজ পেতে ১০ পার্সেন্ট কমিশন গুনতে হয় ঠিকাদারদের। এর মধ্যে কাজভেদে ২-৫ পার্সেন্ট প্রধান প্রকৌশলী, ২ পার্সেন্ট জেনারেল ম্যানেজার এবং ১ পার্সেন্ট অর্থ ডিএনকে (ডিভিশনাল চিফ) দিতে হয় বলে অভিযোগ আছে। বাকি অর্থ যায় সিন্ডিকেট হোতাদের পকেটে।এছাড়াও ১৫ বছর যাবত রেলের পরিত্যক্ত স্ক্রাব টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন শাহ আলম সিন্ডিকেট। রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ৩০-৪০ টাকায় স্ক্রাব টেন্ডারের মাধ্যমে ক্রয় করে উক্ত স্ক্রাব ১২০-১৪০ টাকায় বিক্রি করে আয় করেন কোটি কোটি টাকা।রেলওয়ে সূত্রে জানা যায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগকৃত রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তদন্তের বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য রেল সদর দপ্তরে অবস্থান করতেছেন শাহ আলম ও তার সহযোগীরা। অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য শাহ আলমের মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার ফোন করেও কোন বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |